ফারুক আহমেদকে অপসারণ : নিষেধাজ্ঞায় পড়বে বাংলাদেশ ক্রিকেট? ICC নিয়মে কী আছে?

ফারুক আহমেদকে অপসারণ : নিষেধাজ্ঞায় পড়বে বাংলাদেশ ক্রিকেট? ICC নিয়মে কী আছে?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে ফারুক আহমেদকে। গতকাল রাত ১১টায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার মনোনয়ন বাতিল করার কথা জানায়। ফলে বিসিবির সভাপতি থাকার মুল শর্তই হারিয়ে ফেলেছেন ফারুক আহমেদ। যেকারণে তিনি এখন আর বিসিবি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
এই ঘটনার পরে ফারুক আহমেদ গণমাধ্যমে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘বিষয়গুলো আইসিসিকে জানিয়েছি। আরো কিছু মেম্বারকেও জানিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যেই বিসিবিতে চিঠি আসবে আইসিসি থেকে।’ ফারুক আহমেদের এই বক্তব্যের পরে দেশের ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা। ক্রিকেট বোর্ডে সরকারি হস্তক্ষেপ দেখিয়ে নিষিদ্ধ করা হবে না তো দেশের ক্রিকেটকে? আইনই-বা কি বলছে।
আইসিসির আইন কি বলছে?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডে বা নির্বাচিত কোনো ব্যক্তির উপর (বরখাস্ত) সরকার বা সরকারের অন্যকোনো বিভাগ হস্তক্ষেপ করে। তাহলে আইসিসি কঠিন অবস্থান গ্রহণ করে। এবং সাময়িকভাবে ওই দেশের ক্রিকেটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর আগেও এমন ঘটনা দেখা গেছে। নিষেধাজ্ঞার খড়গে পড়েছিল শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড (এসএলসি)। অবশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) এমন নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে না।
বিসিবিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না কেনো?
বিসিবির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দ্বিস্তর বিশিষ্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে কাউন্সিলরদের ভোটে পরিচালক নির্বাচন করা হয়। এরপর আবার পরিচালকদের ভোটের মাধ্যমে (সম্মতিতে) একজন পরিচালককে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
তবে এই নির্বাচনের মধ্যে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। বিসিবির নির্বাচিত প্রতিনিধির বাইরেও দুইজন পরিচালককে সরাসরি মনোনয়ন দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। তারা নির্বাচন ছাড়াই সরাসরি বিসিবির পরিচালক পদে আসেন। আবার এনএসসি চাইলে, যেকোনো সময় তাদের পরিচালক পদ বাতিল করতে পারেন।
আরো পড়ুন- বাংলাদেশ ক্রিকেট : বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এই নিয়মেই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে না। কারণ, সদ্য বিদায়ী সভাপতি ফারুক আহমেদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিসিবির পরিচালক হননি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তাকে পরিচালক মনোনীত করেছিল। এখন আবার তারাই তার মনোনয়ন বাতিল করেছে।
২০২১ সালের নির্বাচনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত দুই পরিচালক ছিলেন জালাল ইউনুস ও আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। ৫ আগষ্ট দেশের নতুন পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসে সবকিছুতেই। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে বিসিবিতেও। সে কারনেই ক্রীড়া পরিষদের ওই দুই পরিচালককে পদত্যাগ করতে বলা হয়। জালাল ইউনুস স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও ববি করেননি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ববিকে পরিচালক থেকে সরিয়ে দেন। পরে শূন্য দুই পরিচালক পদে নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও ফারুক আহমেদকে পরিচালক মনোনীত করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
সাজ্জাদুল আলম ববিকে যেভাবে পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে ফারুক আহমেদকে মনোনীত করেছিল এনএসসি। একই পদ্ধতিতেই ফারুক আহমেদকে পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও আইসিসির ডেভেলপমেন্ট অফিসার আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে পরিচালক মনোনীত করা হয়েছে। যে কারণে ক্রিকেট বোর্ডে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই। সকল আইন মেনেই ফারুক আহমেদকে অপসারণ করা হয়েছে।
আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে নতুন পরিচালক মনোনয়ন
ফারুক আহমেদের মনোনয়ন বাতিল করার পরই আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে কাউন্সিলরশিপ ও মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। ফারুকের জায়গায় এখন বিসিবির নতুন পরিচালক তিনি। এরপর বিসিবির পরিচালনা বৈঠকে অন্যান্য পরিচালকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্মতিতে বিসিবির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে আমিনুল ইসলামের। আর যদি অন্য কোনো সভাপতি প্রার্থ না থাকে তাহলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হবেন তিনি। এমনটা হলে আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন দেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান। আজই বিসিবির পরিচালনা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

এর আগে সদ্য সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও তিনি পদত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ক্রীড়া উপদেষ্টার সাথে কথা হয়েছে, তিনি বলেছেন, বিসিবির সর্বোচ্চ পদে তারা পরিবর্তন চায়। তারা আমাকে চায় না। কিন্তু পদত্যাগ করতে বলে নাই।’
ফারুক আহমেদের মনোনয়ন বাতিল
ক্রীড়া উপদেষ্টা ফারুক আহমেদকে আকারে-ইঙ্গিতে পদত্যাগের কথা জানালেও তিনি চিন্তা করেন ভিন্ন কিছু। ফারুক পদত্যাগ করবেন না, এমন কথাও শোনা যায়। ফলে সেদিকে না গিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদই তার মনোনয় বাতিল করে দেয়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফারুক আহমেদের মনোনয়ন বাতিল করে এক বিজ্ঞপ্তি দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।

এনএসসির যুগ্মসচিব আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘৮ জন পরিচালক অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করায় এবং বিপিএল সংক্রান্তে গঠিত সত্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে চিঠি
এর আগেই ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন বিসিবির আট পরিচালক। চিঠিতে উল্লেখিত তারিখে দেখা যায় গত বুধবার ক্রীড়া উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দিয়েছেন তারা। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম ফারুকের সাথেই পরিচালক হওয়া নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তিন পৃষ্ঠার দীর্ঘ ওই চিঠিতে ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সেচ্ছাচারিতাসহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ফারুক আহমেদের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতিপরায়নতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, একক আধিপত্য ও ঔদ্ধত্যের কারণে অন্যান্য পরিচালকরা নির্ভার হয়ে তাদের কাজ পরিচালনা করতে পারছেন না। ফারুক আহমেদ একক সিদ্ধান্তেই বোর্ডে সবকিছু করে থাকেন। তার একক সিদ্ধান্তেই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেসহ অন্যান্য কোচদের বিদায় করা হয়েছে।’
এমন ঘটনার কারণে নিরুপায় হয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং বিসিবিকে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে, তার ওপর অনাস্থা আনছেন পরিচালকরা। দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কিছু নমুনাও চিঠিতে তুলে ধরা হয় তিন পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে।
চিঠির জবাবে ফারুক আহমেদ
আট পরিচালকের আনা ওই অনাস্থা চিঠির জবাবও দিয়েছেন ফারুক আহমেদ। গণমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে ওই পরিচালকরা নিজেদের দোষ তার উপর চাপাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ফারুক। সেই সঙ্গে বিসিবির গঠনতন্ত্রে অনাস্থা চিঠির কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
ফারুক বলেন, ‘চিঠিটা আমি দেখেছি। পড়ে হাসতে হাসতে আমার অবস্থা খারাপ। ওরা নিজেরা যা করেছে, সেসবই এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। গত ৩-৫-৮-১০ বছর ওরা যা যা করেছেন, সব অপকর্ম কপি-পেস্ট করে শুধু আমার নামটা বসিয়ে দিয়েছে। কাজ সব ওদের, নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার। যেসব অভিযোগ ওরা করেছে, সব প্রযোজ্য ওদের জন্য।’