বাংলাদেশ ক্রিকেট: বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশ ক্রিকেট: বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ২০০০ সালে আইসিসির পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা পাওয়া দেশটা এখনো যেনো ক্রিকেটের বাচ্চা শিশু। প্রতিটি সিরিজ, প্রতিটি টুর্নামেন্টই যেনো টাইগাদের কাছে এক একটি শিক্ষা সফর। অন্তত টুর্নামেন্ট শুরু এবং শেষের অধিনায়কের বক্তব্য থেকে তাই মনে হয়। এখন তো নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়েছে দেশের ক্রিকেট।
চলতি বছরেই পঞ্চপাণ্ডবের তিনজন (তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ) বিদায় বলেছেন এই ওয়ানডেকে। এরমধ্যে তামিম আর মাহমুদউল্লাহ বিদায় নিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই। রাজনৈতিক দোলাচলে থাকা সাকিব আল হাসান আবার দলে সুযোগ পাবেন কিনা সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। ফলে এখন নতুনদের সুযোগ দিয়ে তৈরি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
পালা বদলের এই আবহে ভালো নেই বাংলাদেশের ক্রিকেট। যদিও নতুনদের প্রতিভা আছে। সেটা কাজে লাগাতে পারলেই আবারো পুরোনো রূপে ফিরবে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলের বর্তমান পারফরম্যান্স ও দলীয় চিত্র
২০০০ সালে বাংলাদেশ আইসিসির পূর্ণ সদস্যের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকেই তিন ফরম্যাটেই খেলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। লম্বা সময়ের এই যাত্রায় বাংলাদেশের প্রিয় ফরম্যাট কেবলই ওয়ানডে। বাংলাদেশের সাফল্যের যতোটুকুই এসেছে সেটা এই একদিনের খেলায়ই। টি-টোয়েন্টিতে কিছুটা উন্নতি করতে পারলেও টেস্টে এখনো অধারাবাহিক বাংলাদেশ। দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও ঘরের মাঠে হার দেখতে হয় বাংলাদেশকে।

গত বছর থেকেই বোলিংয়ে দুর্দান্ত করছে বাংলাদেশ। স্পিন নির্ভর মানুষিকতা থেকে বের হয়ে এসে পেস বিভাগেও দারুণ উন্নতি করেছে টাইগাররা। মুলত তাসকিন আহমেদ, ইবাদত হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, নাহিদ রানা, তানজিম হাসান সাকিবরাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। বিপরীতে ব্যাটাররা নিয়মিত উপহার দিচ্ছে ব্যর্থতা।
গত বছরের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৪ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ খুঁইয়েছে বাংলাদেশ। হোয়াইট ওয়াশ হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ছোট দলগুলোর বিপক্ষে কিছুটা সুবিধা করতে পারলেও বড় দলগুলোর বিপক্ষে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স করেছে বাংলাদেশ।
অভিজ্ঞ ও তরুণ খেলোয়াড়দের সমন্বয়
তামিম-মুশফিকরা অবসর নেওয়ায় জাতীয় দলে অভিজ্ঞ বলতে এখন আছেন লিটন দাস, নাজমুল হোসেন শান্তরাই। টেস্ট ফরম্যাটে সেই দলে যোগ হবেন মুশফিকুর রহিম আর মুমিনুল হকের নাম। কিন্তু সিনিয়ররা নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন না ধারাবাহিকভাবে। এক ইনিংসে রান করলে, ব্যর্থ হচ্ছেন পরের কয়েক ইনিংসে। ইনজুরির থাবা তো আছেই।

বিপরীতে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন তাওহীদ হৃদয়, জাকের আলী অনিক, তানজিদ হাসান তামিম, তানজিম হাসান সাকিবদের প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা। কিন্তু তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতার ঘাটতি স্পষ্ট। যেটা দল গঠনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে নির্বাচকদের জন্য।
বিপিএল ও ঘরোয়া ক্রিকেটের চিত্র
বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি না হওয়ার পেছনে বারবারই উঠে এসেছে ঘরোয়া টুর্নামেন্টের কথা। মানহীন টুর্নামেন্ট নিয়ে কথা বলেছেন স্বয়ং ক্রিকেটাররাই। জিম্বাবুয়ে সিরিজের ব্যর্থতার জন্যও মুমিনুল হক কাঠগড়ায় তুলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটকে।
বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট বিপিএল। টুর্নামেন্টের দশম আসর পেরিয়ে গেলও এখনো নেই উন্নতির ছোঁয়া। বরং কয়েক বছর আগে শুরু হওয়া টুর্নামেন্টগুলোও এগিয়ে গেছে বিপিএল থেকে। সবশেষ আসরেও ফুটে উঠেছে বিপিএলের দুর্দশা। পর্যাপ্ত বিদেশি খেলোয়াড়ের অভাব, খেলোয়াড়দের পেমেন্ট ইস্যু, ব্রডকাস্টিং সমস্যা, মানহীন উইকেট, পরিকল্পনার ঘাটতি, টিকিট বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন; সবই ছিল বিপিএলের গত আসরে। যেকারণে এখনো পিএসএল কিংবা আইপিএলের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না বিপিএল। উঠে আসছে না মান সম্পন্ন খেলোয়াড়।

একই দায়ে দণ্ডিত ঘরোয়া ক্রিকেটের বাকি টুর্নামেন্টগুলোও। বিশেষ জাতীয় ক্রিকেট লিগ (NCL) ও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (DPL)। প্রতিটি টুর্নামেন্টেই কিছু ব্যাটারদের ব্যাটে রানের ফুলঝুরি দেখা যাচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত ডিপিএলেও ব্যাটহাতে রানের ফুলঝুড়ি ফুটিয়েছেন এনামুল হক বিজয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এলেই তাদের দুর্বলতা ফুটে উঠে স্পষ্ট। এর পেছনেও দায়ী মানহীন উইকেট, মানহীন বোলারদের মোকাবিলা করা, কোচিং স্টাফের অভাব এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব।
ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ
দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (BCB)। বিশ্ব ক্রিকেটেরই অন্যতম অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বোর্ড বিসিবি। কিন্তু ক্রিকেটের উন্নয়নে তাদের চিন্তা কিংবা পরিকল্পনা কোনোটাই লক্ষ্য করা যায়নি বিগত দিনে। ক্রিকেট বোর্ডকে বানানো হয়েছিল রাজনৈতিক আড্ডাখানা। রাজনৈতিক পদধারী নাহলে যেনো বোর্ডের পথ রুদ্ধ। সম্প্রতি সামনে আসছে নানাবিধও দুর্নীতির কথাও।
বিগত দিনে দলের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি, খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্য, ফিটনেস ও মিডিয়া হ্যান্ডলিং সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব দেখা গেছে। এখনো যে সেগুলো সব কাটিয়ে উঠেছে তেমনটাও না।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশকে ধরা হতো ক্রিকেটের একটি সম্ভাবনাময়ী দেশ হিসেবে। দেশের মানুষের ক্রিকেটের প্রতি আবেগ, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থলগ্নি; সবই একটি সম্ভাবনার আশা দেখায়। এখনো দেশের হাজারো তরুণ স্বপ্ন দেখে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে চাপানোর। কিন্তু সেজন্য বোর্ডকে একই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তৈরি করতে হবে সূদুর পরিকল্পনা। পরিবর্তন আনতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে। উন্নতি করতে হবে অবকাঠামোগত। তাহলেই বিশ্ব ক্রিকেটে এক শক্তিশালী নাম হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।
- পাইপলাইনে প্রতিভা গড়ে তোলা: অনূর্ধ্ব–১৯ দল পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলে পারফর্ম করে ক্রিকেটাররা। কিন্তু এরপরই হারিয়ে যায় তারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। সুতরাং শুরু থেকেই তাদের সঠিকভাবে গাইড করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করা।
- আধুনিক প্রশিক্ষণ ও ডেটা অ্যানালিটিক্স: বর্তমানে প্রায় প্রতিটি দেশই আধুনিক কোচিং সেট-আপ তৈরি করেছে। অনেক বেশি ডেটা নির্ভর হয়ে কাজ করেন তারা। ডেটা অ্যানালিটিক্সের মাধ্যমে বের করে আনা হয় ক্রিকেটারদের দুর্বলতা। সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ভুলগুলো। খুঁজে বের করা হয় প্রতিপক্ষের দুর্বলতা। বাংলাদেশকেও সেদিকেই ধাবিত হতে হবে।
- বিদেশি কন্ডিশনে অভ্যস্ততা: উপমহাদেশের দেশগুলোতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স মোটামুটি ভালোই থাকে৷ কিন্তু সমস্যা হয় উপমহাদেশের বাইরের দেশগুলোতে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে। সেখানকার পেস বান্ধব কন্ডিশনে খাবি খায় বাংলাদেশ। অনুর্ধ্ব- ১৯ বা ‘এ’ দল থেকেই এই দেশগুলোতে সফর করে, এই কন্ডিশনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া।
- দীর্ঘমেয়াদী নেতৃত্ব গঠন: ক’দিন পরপরই অধিনায়ক পরিবর্তন হয় বাংলাদেশ দলে। এখান থেকে বের হয়ে এসে, দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্ব দেওয়া। যেনো অধিনায়ক নিজের মতো করে দলকে গুছিয়ে নিতে পারে।
উপসংহার
সিনিয়রদের বিদায় আর নতুনদের আগমনে বর্তমানে উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশের ক্রিকেট। দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তন এসেছে বোর্ডেও। এখন দরকার নতুনদের দূরদর্শী পরিকল্পনা, দূর দৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তা-ভাবনা এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নয়ন। এই ধারায় চলতে পারলে দ্রুতই বিশ্ব ক্রিকেটে রাজ করবে বাংলাদেশ।