ক্রিকেট মাঠের উরন্ত পাখি জন্টি রোডস। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট কিংবা গালি অঞ্চলে দাঁড়িয়ে বাজপাখির মতো ক্ষিপ্র গতিতে ঝাপিয়ে পড়ে তার একেকটা বল লুফে নেয়ার চিত্র যেন ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে জগতের সবচেয়ে সুন্দর, মায়াময়, মোহময় ও বর্ণিল ছবিগুলোর একটি। সেসময় তার মাথার উপর দিয়ে কিংবা দু’পাশে শূণ্যে ভাসিয়ে বল পাঠানোর আগে বেশ কয়েকবার চিন্তা করতে হতো ব্যাটসম্যানদের।
তিনি ছিলেন ক্রিকেটের আধুনিক ফিল্ডিংয়ের জনক। ক্রিকেট মাঠে ফিল্ডিংকে যদি একটি আর্ট বলা হয়, তাহলে সাবেক প্রোটিয়া গ্রেট জন্টি রোডস হলো সেই আর্টের শ্রেষ্ঠ আর্টিস্ট। তার একেকটি ক্যাচ, একেকটি ডাইভ কিংবা ক্ষ্যাপাটে থ্রোতে স্ট্যাম্প ভাঙার দৃশ্য চাইলেই ফ্রেমে বাধিয়ে রাখা যায়, বিশ্লেষণ করে দেখা যায় উল্টেপাল্টে। চাইলে এগুলো নিয়ে লেখা যেতে পারে ক্রিকেট জগতের একেকটি কাব্য, মহাকাব্য।
থ্রোয়ে স্ট্যাম্প ভাঙছেন জন্টি রোডস। ছবি সংগৃহীত
‘সর্বকালের সেরা বোলার কিংবা সেরা ব্যাটসম্যান’ নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, ‘সর্বকালের সেরা ফিল্ডার’ নিয়ে মোটামুটি কোনো বিতর্ক নেই। সেখানে জন্টি রোডসের বিকল্প ভাবাটাই দুষ্কর।
দেড় যুগ আগে ক্রিকেট ছাড়লেও এখনো তিনিই সেরা ফিল্ডার। এখনো যায়নি তার ক্যাচ ধরার কিংবা রান আউটের নেশা। দুই-তিন বছর আগে সেটার প্রমাণ দিয়েছেন পাঞ্জাব কিংসের হয়ে কোচিংয়ের সময় ক্যাচ নিয়ে। কিংবা লিজেন্ডস ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক রান আউট।
ক্যারিয়ারের প্রথম ২৫টি ওয়ানডে ম্যাচ শেষে তার ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ২৪.৯৫; নেই পঞ্চোশোর্ধ্ব কোনো ইনিংস। এর মধ্যে আবার ২০ রানের নিচেই আউট হয়েছেন ১৪ বার। তিনি কোনো বোলারও নয় যে, বল করে সেটা পুশিয়ে দেবেন। এমন পারফরম্যান্সের পরে নিশ্চিতভাবেই আর জাতীয় দলের ধারে কাছেও আসতে পারবেন না কেউ। কিন্তু এরপরেও একজন ক্রিকেটার দিব্যি খেলে গেছেন জাতীয় দলে। হ্যাঁ, সেটা শুধুমাত্র তার ফিল্ডিং দক্ষতার জন্যই। তার এমন ফিল্ডিংয়ের কারনেই বিশ্ব ক্রিকেট নতুন করে ভাবনা শুরু করে ফিল্ডিং নিয়ে।
তবে শুধু ক্রিকেটেই নয়, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন জন্টি রোডস। ক্রিকেটের পাশাপাশি তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার হকি জাতীয় দলেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ১৯৯২ সালের অলিম্পিক দলেও ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার দল বাছাইপর্ব পেরুতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ অলিম্পিকেও তিনি দলে জায়গা পান। কিন্তু এবার বাদ সাধে ইনজুরি। ক্রিকেটীয় দক্ষতার কারণে ১৯৯৯ সালের উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ জন খেলোয়াড়ের একজন নির্বাচিত হন।
১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মোট ৪টি বিশ্বকাপ খেলেছেন জন্টি। রঙিন পোশাকে ক্যারিয়ার লম্বা করতে ২০০০ সালে ছেড়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেট। ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে একটি ক্যাচ ধরতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েন জন্টি রোডস। ডাক্তারের হিসেব মতে, চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হতো; কিন্তু এই অবস্থায় আচমকাই অবসর নিয়ে নেন তিনি।
৫২ টেস্টের ৮০ ইনিংসে ব্যাট করে ২৫৩২ রান করেছেন জন্টি রোডস। ৩ সেঞ্চুরিসহ নামের পাশে আছে ১৭টি হাফসেঞ্চুরি। ২৪৫ ওয়ানডে ম্যাচে রোডস ব্যাট করেছেন ২২০ ইনিংসে। করেছেন ৫৯৩৫ রান। ২ সেঞ্চুরির সঙ্গে আছে ৩৩টি হাফসেঞ্চুরি।
ওয়ানডে কিংবা টেস্টের এই সাদামাঠা পরিসংখ্যান নয়, রোডসকে সবাই মনে রাখে তার অতিমানবীয় ফিল্ডিংয়ের জন্য। ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদয়ের মণি কোঠায় আজীবন থেকে যাবেন তিনি। আজীবন ধারাভাষ্যকারদের উদাহরণ হবেন কেউ ভালো ফিল্ডিং করলেই।